বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত। নিয়মিত বন্যা, ঝড়,
জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ জনপদে আঘাত হানে, ফলে হুমকির মুখে পড়ে
এদেশের মানুষের জান-মাল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আরো একটি দুর্যোগ আমাদের জন্য বিশেষ
হুমকির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ভুমিকম্প।আজ আমরা জানবো ভূমিকম্প কি এবং
কেন হয় ও ভূমিকম্পের পর করণীয় বিষয় সম্পর্কে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই অনেক মৃদু থেকে মাঝারি ভুমিকম্প আমাদের দেশে আঘাত আনছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সুনামি, হাইতিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভুমিকম্পের পর
আমাদের চিন্তা আরো বেড়ে গেছে। এখন সকল মনে একটা প্রশ্ন যদি কোন বড় ভুমিকম্প
আমাদের দেশে আঘাত হানে, তবে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে তারপর আমরা কেমন ব্যবস্থা নিতে
পারব? তাই চলুন আজকে ভূমিকম্পের পর করণীয় ও ভূমিকম্প কি এবং কেন হয় এ
বিষয়গুলো ভালো ভাবে জেনে নেয়া যাক।
সূচিপত্রঃ ভুমিকম্প কি এবং কেন হয় - ভূমিকম্পের পর করণীয়
বাংলাদেশ কেন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে তা বুঝতে হলে আমাদের ভূমিকম্প কি এবং কেন
হয় সে সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে হবে। ভূতত্ত্ব পরিবর্তনকারী প্রক্রিয়াসমূহ
প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল। বৈচিত্র্যময় ভূপৃষ্ঠের আকস্মিক বা দ্রুত
পরিবর্তনকারী শক্তিগুলোর মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। কোনো কারনে ভুঅভ্যন্তরে
বিপুল শক্তি দ্রুত মুক্ত হওয়ার সময় ভূপৃষ্ঠে যে প্রবল ছাপা কম্পন সৃষ্টি
হয় তাকে ভূমিকম্প বলে। ভুঅভ্যন্তরের যে স্থানে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় তাকে
কেন্দ্র বলে।
কেন্দ্রের সোজা ভূপৃষ্ঠস্থ বিন্দুর নাম উপকেন্দ্র। ভূমিকম্পের তীব্রতা
অনুযায়ী পৃথিবীর এক প্রান্তে অবস্থিত ভূকম্পনকেন্দ্র হতে সৃষ্ট তরঙ্গ মালা
পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। অবশ্য কেন্দ্র হতে তরঙ্গগুলো যতই
দূরে অগ্রসর হয়; ততই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মৃদু কিংবা প্রবল ভুমিকম্প মাপার
এককের নাম রিখটার স্কেল। ভূমিকম্পের কারণ অনুসন্ধানকালে ভূ-বিদগণ লক্ষ করেন,
পৃথিবীর কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে অধিক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। তাদের মধ্যে নবী
ভঙ্গিল পর্বতমালা ভূগঠনে প্লেটসমূহের (Tectonic Plates) সীমান্ত অঞ্চলে এ
ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন ভূমিকম্প কি এবং কেন হয়.
বাংলাদেশ ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকার কারণ
আপনারা জানেন বাংলাদেশ হলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা একটি দেশ কিন্তু
আপনারা জানেন কি বাংলাদেশ ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকার কারণ ?যদি না জানেন তাহলে
চলুন জেনে নেয়া যাক বাংলাদেশ ভুমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকার কারণ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে
মোট আটটি ভুচ্যুতি এলাকা ক্রিয়াশীল। এগুলো হচ্ছে বগুড়া ভুচ্যুতি এলাকা, তানোর
ভুচ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা ভুচ্যুতি এলাকা, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ভুচ্যুতি এলাকা,
হালুয়াঘাট ভুচ্যুতি এলাকা, ধুবুরি ভুচ্যুতি এলাকা, চিটাগাং ভুচ্যুতি এলাকা,
শাহীবাজার ভুচ্যুতি এলাকা, রাঙ্গামাটি ভুচ্যুতি এলাকা। এসব ভুচ্যুতির জন্য
বাংলাদেশী ভূমিকম্পের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
এছাড়া ইন্ডিয়া-ইউরেশিয়া-বার্মার টেকটনিক প্লেটের সীমান্তবর্তী এলাকার নিকটে
বাংলাদেশের অবস্থান।
হিমালয় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এই টেকটোনিক প্লেট বন্ধ হয়ে আছে। শক্তি সঞ্চয় করছে।
যখন সে শক্তির কাছে এই টেকটোনিক প্লেট বন্ধন মুক্ত হবে তখন শক্তিশালী
ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। যা বাংলাদেশ, উত্তর ভারত ও মায়ানমারের মারাত্মক
আঘাত আনতে পারে। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় প্রতি এক বছর পর টেকটোনিক
প্লেটের সীমান্ত শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের যুগে
মুক্ত বলা যায় না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) জানুয়ারি ২০০৬
থেকে ডিসেম্বর ২০০৯ এ ৩ বছরে ৪ রেক্টার স্কেলের ওপর মাত্রার ১১৫ টি ভূমিকম্প
রেকর্ড করেছে।
এছাড়াও পাঁচ রিখটার স্কেলের আরো ১০ টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে এ সময়।
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এই মৃদু ভূমিকম্পের অধিক্য শক্তিশালী কোন ভূমিকম্পকে
ইঙ্গিত দান করছে। বুয়েট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত 'Seismic Zoning Map' অনুযায়ী
বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা অতি ঝুঁকিপূর্ণ , ৪০ শতাংশ মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং
মাত্র ১৬ শতাংশ আবার বরিশাল, পটুয়াখালীসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। কিন্তু
বঙ্গোপসাগরের চারটি ভূমিকম্পের উৎস ক্রিয়াশীল থাকায় এই অঞ্চলগুলোতে
সুনামিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের ভূমিকম্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
একটি দেশের ভূমিকম্পের রূপ ও ঝুঁকি সম্পর্কে সে দেশের পূর্বের ভূমিকম্পের ডাটা
থেকে জানা যায়।বাংলাদেশের আগে অনেকবার ভূমিকম্প হয়েছে, চলুন বাংলাদেশের
ভূমিকম্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেয়া যাক।ইউরোপীয়রা এ দেশে আসার পূর্বে
ভূমিকম্পের কোন তথ্য সংগৃহীত হয়নি। ১৫৪৮ সাল থেকে সংগঠিত ভূমিকম্প সমূহের ডাটা
সংরক্ষিত আছে । ভূমিকম্পের ডাটা থেকে জানেন যে ১৯০০ সাল থেকে প্রায় ১০০ টি
মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত এনেছে, যার মধ্যে ৬৫টি আঘাত হেনেছে ১৯৬০
সালের পর থেকে । এ ডাটা থেকে আরো জানা যায় গত ৩০ বছরে দেশের ভূমিকম্পের
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে যে আমাদের দেশের জন্য অশনী সংকেত । এই ছিলো
বাংলাদেশের ভূমিকম্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
ভূমিকম্পের পর করণীয়
ভূমিকম্প একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এবং এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটির
ক্ষেত্রে আগে থেকে কোন সতর্কতা সংকেত পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার, তাই
ভূমিকম্পের পর করণীয় বিষয় সম্পর্কে সবসময় আমাদেরকে প্রস্তুত এবং সচেতন
থাকতে হবে। ভূমিকম্পের পর করণীয় কাজগুলো সঠিকভাবে করার জন্য অবশ্যই
আগেই আমাদের জানতে হবে ভূমিকম্পের পর করণীয় বিষয়গুলি। তাই চলুন
ভূমিকম্পের পর করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া
যাক। ভূমিকম্পের সময় মাটির তারল্যিকরণ ঘটে এবং মাটির ধারণ ক্ষমতা কমে যায়।
ফলে বড় বড় বিল্ডিং গুলোকে ধরে রাখতে পারে না। এ কারণে সেগুলো ধ্বংসের মুখে
পতিত হয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ এলাকার মাটির দোআঁশ ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি
অনেকটা বেশি। ইউএআইডি ঢাকা শহরে ভূমিকম্পে ক্ষয় ক্ষতির কারণ বিশ্লেষণ করছে,
যা প্রাপ্তক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশের শহর গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এগুলো
নিম্নরুপ আমাদের দেশের শহরবাসীদের মধ্যে_
১. ভূমিকম্পের পর পরই কি করনীয়, এর সম্বন্ধীয় জ্ঞানের অভাব রয়েছে ফলে
ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে পারে ।
২. শহরের বেশিরভাগ বিল্ডিং ভাসমান তথা কম গভীর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ফলের
মাটির তার তারল্যিকরণের কারণে এগুলো দেবে যেতে পারে ।
৩. বর্ষার সময় যদি ভূমিকম্প হয় তবে মাটিতে পানি পরিমাণ বেশি থাকায় ধ্বংসযজ্ঞ
ভয়াবহ রূপ লাভ করতে পারে।
৪. গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে যা ভূমিকম্প পরবর্তী
পুনর্বাসন কর্মসূচি ব্যাঘাত ঘটাবে ।
৫. রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙ্গে গিয়ে যোগাযোগ ধ্বংস হয়ে যাবে।
৬. পুরাতন ও নিম্নমানের স্কুল ভবন ভেঙ্গে অনেক ছাত্রছাত্রী মৃত্যু ঘটবে।
৭. হাসপাতালের ভবন ধ্বংস হয়ে চিকিৎসা সেবার ব্যাঘাত ঘটবে।
৮. বাংলাদেশের এমনিতেই সম্পদের সল্পতা আছে, কিন্তু সঠিক পরিচালনার অভাবে
ভূমিকম্পের পর যেসব সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব হবে না । এর ফলে
পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ লাভ করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে ৭.৫ মাত্রার এই বড় ভূমিকম্প
ঢাকা শহরের লক্ষাধিক মানুষ এবং প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধ্বংসের কারণ হয়ে
দাঁড়াবে। আর বন্ধরনগরী চট্টগ্রামের অবস্থারও বেশি খারাপ হবে।
ভুমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের করণীয়
ভূমিকম্প এমন এক ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে, যার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো
কোন প্রযুক্তি তুমি তো হয়নি। এ কারণে ভূমিকম্পের যাতে অধিক জান মালের ধ্বংস
না হয়ে সেদিক আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সরকার অনুমোদিত বিল্ডিং কোড অনুযায়ী
ভবন নির্মাণ করতে হবে। ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে যেন খাদ্য পানি ও
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় সেদিকে সরকারি বিশেষ দিতে হবে। তবে সরকারের
একার পক্ষে এ ধরনের মহাবিপর্যয়ের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন
দাতাসংস্থা ও এনজিও ক্ষেত্রে নানা ভূমিকা পালন করতে হবে। দাতাসংস্থাগুলো
ভূমিকম্প মোকাবেলা সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও অন্যান্য
সহযোগিতা করতে পারে। আর এনজিও গুলো যেহেতু একবারে গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত
তাই, তারা জনগণের মধ্যে সচেতনতা করে তুলতে পারে। এছাড়া ভূমিকম্পের উপর যে
উন্নত প্রযুক্তি বিদেশে উদ্ভাবিত হয়েছে আমাদের দেশে প্রকৌশলীদের সে বিষয়ে
সম্যুক ধারণা লাভ করতে হবে। ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক দিক আসলে বিস্তৃত মুখী
তাই, এর মোকাবেলা পদ্ধতি ও বহুমুখী হতে পারে। আমরা একদিনে মোকাবেলা করতে
পারবো না ঠিকই কিন্তু, এর জন্য একটু দেখে পরিকল্পনা অবশ্যই করতে হবে
ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশে
২০১০ সালের এপ্রিলে এক সভায় খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানান, ভূমিকম্পের
পরবর্তী সময় প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে এবছর ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে
সরকার। এছাড়া ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বড়
মাত্র ভূমিকম্পের জন্য এ প্রস্তুতি বড়ই অপ্রতুল। বড় কোন বিপর্যয় মোকাবেলা
করার মতো সামর্থ্য এখনো তৈরি হয়নি। এটি দিকটাকে সরকারের তার বিশেষ নজর দিতে
হবে।
মন্তব্য, ভূমিকম্প পৃথিবীর সবচেয়ে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খুব অল্প
সময়ে মধ্যে এটি একটি দেশের আবাসিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়।
আমাদের মতো দরিদ্র দেশে ভূমিকম্প তাই অভিশাপের দ্বিতীয় নাম। তবে
দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার মধ্যে, এ
কারণে অপ্রত্যাশিত হলেও চরম বাস্তবতায় এই যে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে
বাংলাদেশ। ভূমিকম্প যে বিপর্যয় থেকে আনতে পারে তা মোকাবেলার মতো যথেষ্ট
সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। তাই ভূমিকম্পের বিপর্যয় মোকাবেলায় দেশকে সামর্থ্য
করে তুলতে সরকারের জন্য জনগণকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url